Header Ads

Header ADS

মা কালী - আধাত্মিকতায় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। Goddess kali - in spiritual and political aspect.

যিনি কালকে জয় করেন অর্থাৎ 'কারণ কালং লীয়তে ইতি কালী '৷  কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্ত্তিতঃ ৷ মহাকলস্য কলনাৎ ত্বমা কালিকা পরা ৷ মানে মহাকাল  সব জীবকে গ্রাস করে ৷ অথচ মহাপ্রলয়কালে সেই মহাকালকেও যে দেবী কলন বা গ্রাস করে নিজ অঙ্গে লয় করে নেন তিনিই কালী ৷গূঢ় অর্থ , পার্থিব জগতের যা কিছু  মালিন্যকে জয় করে যিনি পরমব্রক্ষ্মে লীন করেন তিনিই  কালী  ৷ইনি ব্রহ্মময়ী ৷ তৈত্তিরীয় উপনিষদ বলছে কাল বা সময়ের জন্মদাত্রী ৷ আবার যিনি ব্রহ্ম তিনিই কালী ৷কাল+ ঈ= কালী ৷ ঈ -কারে শব্দ উচ্চারন হয়েছে 'ঈশ্বরী' বা সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার জন্য ৷ মা কালী , রজোগুণে সৃষ্টি, সত্ত্বগুণে পালন এবং তমোগুণে সংহার করেন ৷নির্গুণ , নিরাকার হলেন ব্রক্ষ্ম আর তাঁর তরঙ্গ হলেন মহাকালী  শক্তিস্বরূপা ৷ মুন্ডক উপনিষদ বলেছে "সপ্তজিহ্বা দ্বারা দেবী ব্রহ্মান্ডের সগুণ ও নির্গুণ প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ করেন ৷আদ্যা পরমা শক্তি সর্বশক্তির আধার ৷
ক= ব্রহ্ম , আ=অনন্ত ,ল্ = বিশ্বাত্মা ,ই = সূক্ষ্মা ৷



ক্ +আ +ল্ + ই + ক্ +আ =কালী ৷'কাল' শব্দের দুটি অর্থ 'নির্দিষ্ট সময় ' ও 'মৃত্যু '৷ শিবই কাল বোধক  বা মহাকাল ৷  কাল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ কালী ৷ তাঁর শক্তি বা পত্নী কালী ৷ কাল শিবহঃ তস্য পত্নতি কালী 
( শব্দকল্পদ্রুম) ৷ মহাবিশ্বের কৃষ্ণ গহ্বরের কেন্দ্র 'একমেব অদ্বিতীয় ' তিনিই মহাকাল বা মহাকালী ৷ যা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রবল চাপে ও প্রচন্ড তাপে বিস্ফারিত হয়ে সৃষ্টি হয় এই মহাবিশ্ব ৷ সৃষ্টির পর্যায়ে এসেছে 'জীবন' ৷ জীবনের অন্তঃস্থ সৃষ্টি হল 'মন' ৷ মনের সৃষ্টি হল 'আনন্দ'৷ আনন্দের বিকাশ হল'জ্ঞান' ৷  এই জ্ঞানই হল 'সত্ত্ব' ৷ যার অধিষ্ঠান 'চিৎ' -মনের সূক্ষ্মদেহ ৷ যা সচ্চিদানন্দ , মা আনন্দময়ী কালী ৷ 
মহাভারতে (৪/১৯৫) যিনি যোদ্ধা ও পশুদের আত্মাকে বহন করে ৷ কালরাত্রি বা কালী ৷কালী সময়ের পরিবর্তনের , শক্তির ও সংহারের দেবী  ৷ আমরা জীব জগৎ পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমাই ৷ এই নিত্য নিদ্রা মায়ের মহানিদ্রা ও মোহরাত্রি ৷ মহাপ্রলয়ই হল মহারাত্রি ৷৷ কালী হলেন কৃষ্ণ বা মেঘ বর্ণা ও  ভয়কংরী  ৷যিনি  দুর্গা বা পার্বতীর অপর ভয়াল রূপ ৷  আসলে মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করে তাঁর কন্ঠের বিষে হয়েছেন কৃষ্ণবর্ণা ৷ একেই নজরুল বলেছেন মহাকালের কোলে এসে দুর্গা হল -মহাকালী ৷
     শত শত বছরের ইসলামী ও ইংরেজ শাসনের পরিস্থিতি হিন্দু সমাজকে জাগাতে শক্তি মন্ত্রের প্রয়োজনীয়তাতেই বাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন এলাকায় শক্তির দেবীর কালীর আরাধনা ব্যপকতা লাভ করে ৷ এতে মদত জোগায় তৎকালীন হিন্দু জমিদার ও রাজারা ৷ বিশেষত নদীয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্র ৷ অন্য ধর্মের আগ্রাসন রুখতে ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের বিধানে বহু জায়গায় ঘরে ঘরে ,পাড়ায় কালী , দুর্গা ও জগদ্ধাত্রীর মত শক্তির পুজো ব্যাপকভাবে শুরু হয় ৷ নবদ্বীপে প্রথম মৃন্ময়ী প্রতিমা গড়ে সাধক মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ বাংলার প্রথম পুজো করেন দক্ষিণা কালী ৷ ১৬৫৩ সাল থেকে ৪৭৩ বছর ধরে আজও নবদ্বীপ আগমেশ্বরী পাড়ায়  আগমেশ্বরী মাতার পুজো হয় ৷ একই পুজো হয় শান্তিপুরে ৷ উদারচেতা কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্য হিন্দুদের সব সম্প্রদায়ের তন্ত্রের সার ১৭০ টি তন্ত্র গ্রন্থের সারাৎসার নিয়ে 'বৃহৎ তন্ত্রসার' বই লিখে এই পুজোর পদ্ধতি জানিয়ে দেন ৷ ইসলামের ও বৈষ্ণব ধর্মের শুধুমাত্র ভক্তিমার্গের বিপরীতে শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক যুগস্রষ্টা পুরুষ শাক্ত তন্ত্র শাস্ত্রে পন্ডিত কৃষ্ণানন্দ হিন্দু সমাজে শক্তি চেতনা জাগ্রত করেন ৷তিনি বাংলার নানা প্রান্তে পূজিতা লৌকিক দেবদেবীদের সংহত রূপ দেন ৷ পুরাণের বিবরণ ও লৌকিক প্রতিমা সমূহের আকৃতিগত ও পূজা পদ্ধতির বিভিন্নতা দূর করে কালীর এমন মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন ৷ এরপর শাক্ত চেতনার বিকাশ ঘটান রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব , স্বামী বিবেকানন্দ ,বামাক্ষ্যাপা , রামপ্রসাদ সেন , কমলাকান্তর মত সাধক ও ধর্মবেত্তারা ৷ এরফলে কালী বাংলাসহ বিভিন্ন স্থানে সর্বসাধারণের দেবী হিসাবে ব্যাপকভাবে পুজো পেতে থাকেন ৷ কালিকা পুরাণ , বরাহ পুরাণ ও মার্কন্ডেয় পুরাণে কালীর লোলজিহ্বাধারী আবার শান্ত সমাহিত দুটি রূপেরই প্রকাশ দেখি ৷ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের  আনন্দমঠের মত উপন্যাস স্বদেশী আন্দোলনে কালীকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে ৷ সচেতনভাবে বঙ্কিমচন্দ্র রাজনৈতিক উপন্যাস হিসাবে না লিখলেও আনন্দমঠ  ও তার মধ্যে লেখা  বন্দেমাতরম গানটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা নেয় ৷ এখানে দেবী হয়ে উঠেছেন দেশমাতৃকা ৷বিদ্রোহীদের নেতা মহেন্দ্রকে ভারতমাতার তিনটি মুখ দেখিয়ে তিনটি ঘরে তিনটি দেবী জগদ্ধাত্রী , কালী ও দুর্গার পুজো করা দেখিয়েছেন ৷ "মা কালী" -কে জানতে আমি বারবার ভগ্নি নিবেদিতার  Kali The Mother পড়ি ৷ তিনি একই সাথে মা কালীর করুণাময়ী এবং প্রলয় লীলায় রুদ্র রূপ দেখেছেন ৷ যেখানে কালীর মুখ দিয়েই তিনি বলাচ্ছেন , যে মনে রেখো , যে আমি উচ্চস্বরে ডাকি , সেই আমিই কীভাবে সাড়া দিতে হয় তাও দেখিয়ে দি ৷ভেবে নাও আমার খুশির জন্য এই পৃথিবীতে তুমি এসেছো ৷ যখন রাত্রি ঘনাবে চরিতার্থ হবে আমার আকাঙ্জ্ঞা , তখন তারই খুশির টানে তোমায় ফিরিয়ে নেব আমারই আশ্রয়ে ৷দেশে ত্যাগের বাতি জ্বললে মানুষ ভোগের জন্য নয় আত্মবিসর্জন দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠবে ৷৷ যা পরাধীন ভারতবর্ষে দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের বার্তা নিয়ে হাজির হয় ৷ মুক্তিসংগ্রামে প্রবল ঢেউ তোলে ৷   সিস্টার নিবেদিতার এই বইটি প্রসঙ্গে ঋষি অরবিন্দ বলেছিলেন , বইটি পড়ে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন ৷ বইটি শুধু আধ্যাত্মিক নয় সমাজজীবনের বিপ্লবেরও রূপ ! মৃত্যুরূপা মাতা  কবিতায় নিবেদিতা লিখেছেন , 
        Who dares missery love , 
         And  hug the form of Death .
         Dance in Destruction's dance 
         To him the Mother comes 
( সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায় , মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে / কাল -নৃত্য করে উপভোগ ,/ মাতৃরূপা তারি কাছে আসে )৷১৯৪৪ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের পবিত্র মোহন রায়কে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন , শোন , আমি জীবনে কোনদিনই রাজনীতি করিনি ৷ যা দেখছো এ আমার মাতৃসাধনা ৷ আমার কাছে গর্ভধারিণী জননী , জননী -জন্মভূমি , আমার মা কালী একই ৷ মা কালী একজন সাধক বা সাধিকার কাছে যেন নিজের মা ৷ আবার মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে দেশমাতা৷ঈশ্বরের ঈশ মাতৃকা রূপটিই হিন্দু শাক্ত ধর্মে কালী ও দুর্গাকে একবারে ঘরোয়া মা বা মেয়ের মত  আবার দেশমাতার মত বড় আপন করে দেখিয়েছে ৷ 

কোন মন্তব্য নেই

thanks. please visit again

Blogger দ্বারা পরিচালিত.