Header Ads

Header ADS

মা কালীর প্রসঙ্গ। Various aspects of Maa kali

মা কালীর প্রসঙ্গ। Various aspects of Maa kali


দশমহাবিদ্যার প্রথম ও আদি রূপ হল কালী। দেবীর সৃষ্টি, প্রাচীনত্ব ও বিশালতার উল্লেখ পাওয়া যায় বেদ, রাত্রিসূক্ত, ঐতরেয় উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ, হরিবংশ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, শ্রীশ্রীচণ্ডী, কালিকা পুরাণ, শতপথ ব্রাহ্মণ প্রভৃতি গ্রন্থে। ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্তে দেবীর বর্ণনা – রাত্রি ব্যাখ্যাদায়ত্রী পুরুত্রা দেব্যক্ষোভি বিশ্ব অধিস্ত্রিযোহধিতঃ – অর্থাৎ রাত্রিদেবী স্বয়ং নিজেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নক্ষত্রমালায় বিভূষিতা হয়ে  প্রকাশ করেছেন কালী রূপে। ঋগ্বেদেই দেবী তাঁর আত্মপরিচয় দিচ্ছেন – অহম্‌ রূদ্রেভির্বসুভিশ্চ রামাম্মোহম হিতৈরুতো বিশ্বদেবৈ, অহম্‌ মিত্রা বরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রানী অহমশ্রিনোভা। অর্থাৎ আমি রুদ্র, সূর্য, বসু, আদিত্য, বরুণ, ইন্দ্র প্রভৃতি সর্বদেবের পূজিতা। উপনিষদে মহাকালীর উল্লেখে পাওয়া যায় – যং কাময়ে তনুমুদ্রং কৃণোমি তং ব্রহ্মনং তং ঋষিং সুমেধাম্‌ – অর্থাৎ আমি ইচ্ছা করলে শক্তিমান করি, ভক্ত করি, ঋষি করি, জ্ঞানী করি। মুণ্ডক উপনিষদে দেবীর বর্ণনা – কালী করালী চ মনোজবা চ সুলোহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচি চ দেবী লোলায়মানা ইতি সপ্তজিহ্বার। দেবী ব্রহ্মাণ্ডের সগুণ ও নির্গুণ প্রকৃতির ওপর সপ্তজিহ্বা দ্বারা নিয়ন্ত্রণকারিণী। রামায়ণে পাই, বশিষ্ঠ মুনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন ‘দক্ষিণাকালী’ রূপে দেবীকে আরাধনা করে। আদ্যাশক্তি মহামায়ার আটটি রূপ – দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, উগ্রকালী, গুহ্যকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী এবং চামুণ্ডাকালী। দেবী করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, নৃমুণ্ডমালা বিভূষিতা। তিনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা বা শ্যামাঙ্গী। দেবীর রূপ দিগম্বরী। তিনি ত্রিনেত্রা, উন্নতদন্তা এবং শবরূপী মহাদেবের হৃদয়োপরি অধিষ্ঠিতা। ‘কাল’ অর্থাৎ সময়ের জন্মদাত্রী, পালনকর্ত্রী এবং প্রলয়কারিণী নিয়ন্ত্রক বলেই দেবীর নাম ‘কাল’ যুক্ত ‘ঈ’ – ‘কালী’। ‘ঈ’ কারের সৃষ্টি ও শব্দোচ্চারণ হয়েছে ‘ঈশ্বরী’ বা সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার জন্য। এ সব অত্যন্ত গুরু তত্ত্ব।




মধ্যযুগের শেষের দিকে বাঙালীর ভক্তিমূলক সাহিত্যে কালী ব্যপক স্থান নিয়ে বিরাজমান। সাধক রামপ্রসাদ সেন ( ১৭১৮ - ১৭৭৫) এর মতো কালীভক্ত উপাসকরা কালীকে নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য ভক্তিমূলক গান। অথচ শিবপত্নী হিসেবে পার্বতীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে নানা কাহিনীতে উচ্চারিত হওয়া ছাড়াও অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে বাঙালির ঘরে ঘরে আবাহনী গেয়ে পূজিত হতে কদাচিৎ দেখা গেছে। আর বাঙালির ঘরে তাঁর  ভয়াল রূপের বর্ণনা, বৈশিষ্ট্য, অভ্যাসসমুহ উল্লেখযোগ্য কোন রূপান্তর ঘটেনি।স্বামী বিবেকানন্দ মৃত্যুরূপা কালী  নামে এবং তাঁর শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা মাতৃরূপা কালী  নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ লিখেছিলেন ৷ বাংলায়  অনেক কালীমন্দির আছে । এর অনেক গুলোই সুপ্রাচীন।




 কালীঘাট , দক্ষিণেশ্বর ও আদ্যামা ,তারাপীঠ ,বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা ,কালনা সিদ্ধেশ্বরী , কাটোয়ার খেপি মা , ক্যানিং এর গৌড়দহ কালী , শান্তিনিকেতনের কংকালীতলা , হালিশহরের রামপ্রসাদী কালী , তমলুকের বর্গভীমা, আকালীপুরের গুহ্যকালী , ভবানী পাঠকের কালী  প্রভৃতি বিখ্যাত এবং ঢাকার রমনা কালীমন্দির তেমনি একটি পুরাতন কালী মন্দির( যদিও পাক সেনারা আদি মন্দির ভেঙ্গে দিয়েছিল ) ব্রহ্মযামলে উল্লেখ আছে 'কালিকা বঙ্গদেশে চ' অর্থাৎ বঙ্গদেশে দেবী কালিকা বা কালী নামে পূজিতা হন। নানা রূপে, নানা স্থানে কালী পূজিতা হন, যেমন দক্ষিণা কালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী,মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি নামে মাহাত্ম্যে এ কালীর মধ্যে কিছু কিছু ভিন্নতা বর্তমান। অন্যদিকে বিভিন্ন মন্দিরে দশমহাবিদ্যা ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী ইত্যাদি নামে কালীর পূজা হয়‌ । চট্টগ্রাম শহরের চট্টেশ্বরী, শ্রী কালীবাড়ী, গোলপাহাড় শ্মশান কালীবাড়ী, দেওয়ান হাটের দেওয়ানেশ্বরী কালীবাড়ী, সদরঘাট কালীবাড়ী, পটিয়া পিঙ্গলা কালীবাড়ী, ধলঘাট বূড়াকালী বাড়ী সহ চট্টগ্ৰামে অনেক প্রসিদ্ধ  কালী মন্দির বর্তমান‌। এর প্রায় প্রত্যেকটিতে প্রত্যেক শনি ও মঙ্গলবার এবং অমাবস্যায় কালীপূজা হয়। মণ্ডপে যেখানে দুর্গাপুজা হয় সেখানে অধিকাংশ মণ্ডপে কালীপূজাও হয়ে থাকে। অনেক কালীসাধক বিখ্যাত এবং শ্রদ্ধার্হ। শ্রীরামকৃষ্ণ কালীর উপাসক ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ও কালীর ভক্ত ছিলেন। কালী প্রশস্তিমূলক গান তথা শ্যামাসঙ্গীত বাংলা গানের একটি ভিন্ন ধারা। কালী সাধক রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য এ ধারায় অন্যতম অবদান রাখেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং কাজী নজরুল ইসলাম ও এ ধারায় উৎকৃষ্ট মানের গান রেখে গেছেন। নিরক্ষর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবী কালী সচেতনতায় সিক্ত হয়ে অনবদ্য বাণী উচ্চারণ করতেন যা শ্রীম রচিত অমর গ্ৰন্থ 'রামকৃষ্ণ কথামৃত' তে স্থান পেয়েছে।  পঞ্চাক্ষর মন্ত্র - ওঁ হ্রিং স্ত্রিং হুঁ ফট্ ৷ কালরাত্রির্মহারাত্রিশ্চ দারুণা ৷ ত্বং শ্রীত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্বং বুদ্ধির্বোধলক্ষণা ৷
   তিনি সত্ত্ব ,রজঃ ও তমঃ পরিণামবিধায়িনী ৷ তন্ত্রে পাশ হল বন্ধন ৷ শরীর ঢাকার কাপড় নয় ৷ সূক্ষ্ম শরীর
ঢেকে রাখে বিভিন্ন পাশ ৷ কারী পাশ দিয়ে আমাদের ঢেকে রাখেন ৷ সাধকদের আরাধনা পাশ মুক্ত হওয়ার ৷ আত্মাকে পাশ দিয়ে না ঢেকে আমাদের কুন্ডলিনী শক্তিকে জাগাতে পারলে আমরা নাম ,যশ , অর্থ , খ্যাতি ,ঈর্ষা থেকে দূরে রাখতে পারবো ৷ পাশ মুক্ত বলে মা  দিগম্বরী বা বিবসনা ৷ নিজের দর্শন , শ্রবণ , ঘ্রাণ , কাম থেকে বাকশক্তিকে বিবাসনা করাই সাধনার লক্ষ্য ৷ মায়ের এক পা অতীতে তাই অলীঢ়পাদা অন্য পা টি ভবিষ্যতে তাই প্রত্যালীঢ়পাদা ৷ খেচর মানে আকাশচারী ৷ মায়ের জিভ তাই খেচরী মুদ্রায় থাকে ৷ শূন্য ভাসমান দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে তাঁর জিভ ৷ জীবনের রহস্য রয়েছে মৃত্যুর মধ্যে ৷ যমের শক্তি তাঁর চুলে বলে তিনি মুক্তকেশী ৷দীপাবলী বা দীপান্বিতা বা আশ্বিনী অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত কালীপূজা উপলক্ষে দেবী মূর্তির দক্ষিণা কালীর অবয়বে তৈরী হয়, এক্ষেত্রে দেবীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দেবী করালবদনা, কৃষ্ণবর্ণা, নীলবর্ণা বা মহামেঘবর্ণা। দেবী আলুলায়িত কেশ। রামপ্রসাদী গানে ভক্তিভরে মাকে বল হচ্ছে, '.... এলোকেশী সর্বনাশী......, মা এলোকেশী, রক্তচক্ষু, লোলজিহ্বা, চতুর্ভূজা, নরমুন্ডু-মালিনী, নর হস্তের কোমর বন্ধ, বাম করযুগলে উন্মুক্ত খড়্গ এবং নরমুণ্ড, ডান করদ্বয়ে বর ও অভয়মুদ্রা। দক্ষিণা কালীর দক্ষিণ পা শিবদেহে স্পর্শমান, বাম পা খানিকটা দুরত্বে।শব রূপ শিব বা স্বামীর গায়ে পা পড়ায় অসুর - রক্ত পানে সিক্ত জিহ্বায় কামড়। ত্রিনয়নী মা অসুর হত্যার মহাঘোরে হাস্যরতা ও ভয়াল দর্শন ।  মায়ের গলায় নৃমুণ্ড মালায় সাধারণত১০৮টি অথবা ৫১টি নরমুণ্ড বর্তমান‌। ১০৮হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র সংখ্যা, মন্ত্রপাঠের সময় গোনার জন্য জপমালায় ১০৮টি গুঠিকা থাকে। দেবনাগরী বর্ণমালায় সর্বসমেত ৫১টি বর্ণ আছে। হিন্দুদের বিশ্বাস সংস্কৃত একটি চলমান জীবন্ত ভাষা এবং এর ৫১ টি বর্ণমালায় অপার শক্তি নিহিত রয়েছে।মায়ের কোন চিরস্থায়ী গুণ বা প্রকৃতি নেই, যার মানে দাড়ায় বিশ্ব-প্রকৃতি ধ্বংসের পরেও তিনি বর্তমান থাকবেন । তিনি মায়াতীতা ৷ আমরা মনে করি -মা দীন ও দয়াময়ী , দুখহরা ৷ মা তুমি সন্ধ্যা ,
তুমি গায়ত্রী , তুমি জগদ্ধাত্রী , অকুলের ত্রাণকর্ত্রী ৷
আমার মা ত্বং হি তারা ৷

স্বামী বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) মধ্যে মা কালীর যে অনুভূতি, আধ্যাত্মিক দর্শণ দেখা গিয়েছিল, সেটাই তাঁর মধ্যে আসাধারণ শক্তি-সামর্থ্যের সঞ্চার করে...  বিবেকানন্দের মতো এত বড় ব্যক্তিত্ব, কিন্তু জগন্মাতা মা কালীর প্রতি ভক্তিতে ছোট শিশুর মতো বিহ্বল হয়ে যেতেন। শক্তি সাধানার এমনই সামর্থ্য সবসময় পুজনীয়  স্বামী আত্মস্থানন্দের মধ্যেও দেখতাম। আমার মতে আছে, যখনই বেলুড়মঠে যেতে হত, গঙ্গার তীরে বসে, দূরে মা কালীর মন্দির দেখে স্বাভাবিকভাবেই একটি আকর্ষণ তৈরি হত। যখন আস্থা এতটা পবিত্র, তখন শক্তি নিজেই পথ দেখায়। 

কোন মন্তব্য নেই

thanks. please visit again

Blogger দ্বারা পরিচালিত.