জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস : প্রাচীন কাল থেকে কলোনিয়াল পরবর্তী যুগ। History of Jagadhatri pujo: From ancient period to post Colonial period.
জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস: প্রাচীন থেকে পোস্টকোলোনিয়াল যুগ
জগদ্ধাত্রী উপাসনার প্রাচীনত্ব এবং মধ্যযুগের শেষে, নবাবী আমলের অন্তিম লগ্নে এই উপাসনার পুনরুত্থান বাঙালি জাতির প্রকৃতিমাতৃকা ধর্মের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন।
প্রথমত, একজন সিংহবাহিনী মাতৃকার উপাসনা অত্যন্ত প্রাচীন সুমের সভ্যতায় সিংহবাহিনী মাতৃকার উপাসনা হত। সিংহমাতৃকা উপাস্য ছিলেন এলামাইট সভ্যতায়, যাদের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার ঘনিষ্ঠ সংযোগ (দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদীরা বলেন যে এলাম আসলে তামিল শব্দ। এবং এই এলাম থেকে এসে হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তোলেন দ্রাবিড় জাতির পূর্বসূরীরা)। হরপ্পা সভ্যতায় সিংহমাতৃকার হদিস এখনও মেলেনি, তবে ব্যাঘ্র মাতৃকার সিল পাওয়া গেছে। বাংলায় পালযুগ থেকেই নিয়মিত একজন সিংহবাহিনী মাতৃকার উপাসনা হয়, মূলত চণ্ডী বলি তাঁকে। তাঁর আরেকটা নামও আছে শ্রী শ্রী চণ্ডীতে, মার্কণ্ডেয় পুরাণের যে অংশটি কোনোমতেই ষষ্ঠ শতকের পরে নয় (ওয়েন্ডি ডোনিগার): জগদ্ধাত্রী। দেবী পুরাণেও এই জগদ্ধাত্রী আছেন। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ষোড়শ শতকে বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থে জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ করেন। চতুর্দশ শতকে শূলপাণি তাঁর কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে যাঁর উপাসনার কথা বলেছেন, তিনি জগদ্ধাত্রীং সিংহপৃষ্ঠে অর্থাৎ সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রী।
রামপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত গ্রন্থে দেখা যায় পালযুগে উমা পুজোয় মহা ধুমধাম করে উৎসব হত। এরপর ওই পালযুগেরই স্মৃতিসাগর গ্রন্থে (রাজা মদনপালের সময়ে নৃসিংহভট্টের লেখা, অর্থাৎ দ্বাদশ শতক। তন্ত্রবারিধি ডাক্তার রক্তিম মুখার্জির সৌজন্যে স্মৃতিসাগরের সময়কাল প্রাপ্ত হল) বলা হচ্ছে যে কার্তিক মাসে উমা পুজো হয়। এই উমা পুজো ও জগদ্ধাত্রী পুজো যে অভিন্ন, সন্দেহ নেই। পালযুগের তন্ত্রবিষয়ক পুঁথিগুলিতে জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়। পালযুগে অষ্টম শতকের একটি জগদ্ধাত্রী মূর্তি পাওয়া গেছে, বরিশালে প্রাপ্ত, বর্তমানে আশুতোষ মিউজিয়ামে।
কৃষ্ণচন্দ্র নতুনভাবে প্রচলন করেছিলেন এই জগদ্ধাত্রী পুজো। একাধিক কাহিনী আছে। একটিতে তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন এবং জগদ্ধাত্রী তাঁকে মুক্ত করেন। আরেকটিতে তিনি কারারুদ্ধ হন ফলে দুর্গাপুজো কারাগারে কাটাতে বাধ্য হন, অথবা দুর্গাপুজোর দশমীর দিনই কারাগার থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। সবগুলি কাহিনীতেই তথাকথিত স্বাধীন নবাবদের সময়ে হিন্দুদের রাজা ও জমিদারদের ওপরে extortionist অত্যাচারের ইঙ্গিত আছে।প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি বৈকুণ্ঠ নামে একটা dungeon তৈরি করে সেখানে হিন্দু রাজপুরুষদের আটকে রাখতেন আমরা জানি। শেষ নবাব মিরকাশিম রাজা রাজবল্লভকে নির্মমভাবে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারেন। কৃষ্ণচন্দ্রও সেভাবেই মরতেন কিন্তু তিনি মুঙ্গের দুর্গের কারাগার থেকে পালাতে সক্ষম হন।
এবার কৃষ্ণচন্দ্র পুনঃপ্রচলন করে থাকলেও জগদ্ধাত্রী একেবারে অপ্রচলিত ছিলেন না মধ্যযুগে । উপরন্তু নদীয়া জেলায় বিশেষ করে জগদ্ধাত্রী পূজিত হতেন নদীয়া রাজবংশের উদ্যোগে, কৃষ্ণচন্দ্রের আগেই, কারণ জলেশ্বর ও রাঘবেশ্বর নামে দুটি শিবমন্দির, যথাক্রমে ১৬৬৫ ও ১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত, তাদের প্রাকারগাত্রে জগদ্ধাত্রী মূর্তি আছে বলে জানা যাচ্ছে।জগদ্ধাত্রী পুজো প্রকৃতিমাতৃকা ধর্মের সার্বজনীন রূপ প্রচলনের উদ্দেশ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গুহ্য তান্ত্রিক বিকৃতি কাটিয়ে উঠে আবহমানকালের মাতৃকা উপাসক জাতিকে মাতৃক্রোড়ে ফেরানোর আরেকটি সফল উদ্যোগ, সার্বজনীন কালীপুজোর পাশাপাশি। এই কৃতিত্ব কৃষ্ণচন্দ্রর। জগদকারণ প্রকৃতির রূপ হিসেবে হেমন্তে আমরা মা জগদ্ধাত্রীর পুজো করি, যা বাঙালির ধর্মে প্রকৃতিমাতৃকার সর্বোচ্চ স্থানটির উদ্দেশ্যে আভূমি প্রণতির আবহমান আহ্বান, শঙ্খধ্বনি। কৃষ্ণচন্দ্র কোন নবাবের কারাগৃহে বন্দী ছিলেন, নিশ্চিত করে বলা যায় না: আলীবর্দী থেকে মিরকাশিম যে কেউ হতে পারেন। তবে এটুকু নিশ্চিত যে বাংলায় নবাবী আমল যেমন যেমন দুর্বল হচ্ছিল, বাংলার কাফের হিন্দু তেমন তেমন নিজের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করছিল। এ দুয়ের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক, হ্যারি পটার আর ভোল্ডেমোর্ট রকমের বলতে পারেন। হাতির দাঁতের একটি জগদ্ধাত্রী মূর্তি নাকি ঢাকার শিল্পী কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে। সেটাই কিনা জানি না তবে এই আইভরি জগদ্ধাত্রী মূর্তির চিত্রটি পিন্টারেস্ট সাইটে পেলাম। জগদ্ধাত্রী পটচিত্র ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আছে। আর দ্বিসিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রী ফরিদপুরে প্রাপ্ত, গুরুসদয় মিউজিয়ামে আছে।
কোন মন্তব্য নেই
thanks. please visit again