Header Ads

Header ADS

সরস্বতী পূজা কী ও কেন ? । what is saraswati puja ?

 সরস্বতী পূজা কী ও কেনো ?



কোনো হিন্দুকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, দেবী সরস্বতী কে ? বলবে, জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী। আর ? আর কোনো তথ্য তার কাছে নেই। এরপর হয়তো দু’চার জন হিন্দু বলতে পারবে যে, সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী; কিন্তু এই জানাও যে ভুল এই লেখাটি পড়তে থাকলে তা এক সময় বুঝতে পারবেন।
আমরা যেমন- ব্যবসায়িক, বন্ধুত্ব বা বিবাহ এমনকি শিক্ষাগুরু ধরতে গেলেও তার সম্পর্কে ভালো করে জানার চেষ্টা করি এবং তারপর তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করি; তেমনি যখন কোনো দেব-দেবীর পূজা আমরা করবো, তখনও আমাদের উচিত সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে তার আরাধনা করা, তাহলেই কেবল আমাদের পূজ-প্রার্থনা সফল ও সার্থক হবে।
সরস্বতী পূজা সম্পর্কে যেহেতু এই লেখা, সেহেতু প্রথমেই যে প্রশ্নের মিমাংসা করতে হবে যে, দেবী সরস্বতী আসলে কে ? আবার আমরা সাধারণভাবে অনেকেই কোনো দেব-দেবীকে ছোট এবং কোনো দেব-দেবীকে বড় বলে মনে করি, কিন্তু কোনো দেব-দেবী ই যে ছোট বড় নয়, সকল দেব-দেবী ই যে সমান, এই লেখাটি পড়লে এই তত্ত্বেরও একটা সংক্ষিপ্ত সমাধান পাবেন।
হিন্দুশাস্ত্র মতে, সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হলো পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ব্রহ্মও বলা হয়। পরমাত্মারূপে এই ব্রহ্ম সবকিছুর মধ্যে বিরাজিত, এই জন্যই হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম
এর অর্থ হলো- সকলের মধ্যে ব্রহ্ম বিদ্যমান। - (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১, বেদান্ত দর্শন)
পরমব্রহ্ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তার নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তার নাম বিষ্ণু; যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তার নাম শিব বা মহেশ্বর। কিন্তু আমরা স্থূল দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে বিভক্ত করে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরে এই তিনভাগে বিভক্ত করেছি এবং এই তিনটি সত্ত্বাকে আলাদা আলাদা তিনটি রূপ দান করেছি। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, এগুলো জাস্ট তিনটি নাম এবং এই তিনটি নাম পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের তিনটি কার্যকরী রূপের নাম মাত্র।
ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ব্যাপারটা সহজে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে; তো যখন প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করেন বা ফাইলে সই করেন, তখন তিনি কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী। ব্রহ্মও ঠিক সেরূপ, তিনি যখন যে কাজ করেন, তখন সেই রূপের নামে কাজটি করেন, সেই তিনটি নামই হলো- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর।
এই ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করার জন্য বলছি, অনেকে বা সকলেই জানেন, বিষ্ণু পালন কর্তা। তাহলে বিষ্ণুর অবতারদের তো যুদ্ধ, ধ্বংস, বিনাশ এই সব করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিষ্ণুর আংশিক অবতার রাম কি যুদ্ধ করে রাবনের বংশকে বিনাশ করে নি ? বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার শ্রীকৃষ্ণ কি নিজে কংস, শিশুপাল, নরকাসুরকে হত্যা করে নি ? কৃষ্ণ কি ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ, দুর্যোধনকে হত্যা করায় নি ? পাণ্ডবদের মাধ্যমে কুরুবংশকে ধ্বংস করে নি ? বিষ্ণু যদি কোনো আলাদা সত্ত্বা হতো আর তার কাজ শুধু যদি পালন করা হতো, তাহলে কি সে এই যুদ্ধ, বিনাশগুলো করতো ? আসলে এগুলো করিয়েছেন ব্রহ্ম, আমাদের শাস্ত্রকারা তাদেরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কল্পনা করে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র। না হলে পৃথিবীতে এত বিষ্ণুর অবতার, সেই তুলনায় ব্রহ্মা ও শিবের কোনো অবতার নেই কেনো ? আসলে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তো আলাদা কেউ নয়। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তারই নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তারই নাম বিষ্ণু এবং যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তারই নাম শিব বা মহেশ্বর; যে কথা একটু আগেই বলেছি এবং যে কথা বলা আছে গীতার এই শ্লোকে-
অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্ ।
ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ ।
অর্থ- পরমেশ্বরকে যদি যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবু তাঁকে সংহার কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।
এতক্ষণে পাঠক-পাঠিকাদেরকে নিশ্চয় এটা বোঝাতে পেরেছি যে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কেউ নয়, তারা একই ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ; এই ব্রহ্ম যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করেন তখন তার নাম হয় ব্রহ্মা, আর যেহেতু যেকোনো কিছু সৃষ্টি করতেই লাগে জ্ঞান এবং প্রকৃতির নিয়ম হলো নারী ও পুরুষের মিলন ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি বলতে সাধারণ অর্থে এখানে মানুষকেই বোঝানো হচ্ছে, সেহেতু প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই ব্রহ্মার নারীশক্তি হলো সরস্বতী, যাকে আমরা স্থূল অর্থে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে মনে করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই, এমন কি ব্রহ্মা বলেও আলাদা কোনো সত্ত্বা নেই, লেখক কর্তৃক গল্প-উপন্যাসে, একাধিক চরিত্র সৃষ্টির মতো সবই ব্রহ্মের খেলা, এখানে ব্রহ্মই সবকিছু ।
যা হোক, কোনো কিছু তৈরি বা সৃষ্টি করতে হলে যেমন লাগে জ্ঞান, তেমনি সৃষ্টিকে নিখুঁত করার জন্য নজর রাখতে হয় চারেদিকে, এই চারিদেকে দৃষ্টি রাখার জন্যই কল্পনা করা হয়েছে ব্রহ্মার চারটি মাথা এবং তার নারীশক্তি সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে জ্ঞানের দেবী হিসেবে।
আজকের প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, দেবী সরস্বতী আসলে কে ? উপরের আলোচনা থেকে এতক্ষণে নিশ্চয় এটা বুঝতে পেরেছন যে, পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সৃষ্টিকারী রূপের নাম ব্রহ্মা আর ব্রহ্মার নারী শক্তির নাম সরস্বতী; এর মানে হলো সরস্বতীই ব্রহ্মা, আর ব্রহ্মা মানেই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর, অর্থাৎ সরস্বতীই পরমেশ্বর বা ঈশ্বর। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, সরস্বতীকে ছোটো দেবী হিসেবে এতদিন মনে করে এলেও সরস্বতী মোটেই কোনো ছোটো দেবী নয়; সরস্বতী, ঈশ্বরেরই একটা রূপের নাম এবং স্ত্রীলিঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বরীরূপে সরস্বতীই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর।
এবার নজর দেওয়া যাক সরস্বতী পূজার বা সরস্বতী দেবীর সাথে থাকা অন্যান্য বিষয়গুলো দিকে –
দেবী সরস্বতীর গায়ের রং হয় সব সময় সাদা বা শ্বেত-শুভ্র জাতীয়, খেয়াল করে দেখবেন সরস্বতীর মূর্তিতে লাল কালো বা অন্য কোনো রং ব্যবহার করা হয় না। দেবী সরস্বতীর শুভ্রমূর্তি আসলে নিষ্কলুষ চরিত্রের প্রতীক; এটা এই শিক্ষা দেয় যে, প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে হতে হবে নিষ্কলুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী; যে ছেলে মেয়ে বাল্যকাল থেকে নিজেকে নিষ্কলুষ রাখার চেষ্টা করবে, সে যে সারাজীবন তার সকল কর্ম ও চিন্তায় নিজেকে নিষ্কলুষ রাখতে পারবে, তাতে তো আর কোনো সন্দেহ নেই।
সরস্বতী পূজায় আর একটি অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে দেবী সরস্বতীর সাথে থাকা রাজহাঁস। রাজহাঁসকে প্রায় সবাই সরস্বতীর বাহন বলে মনে করে। কিন্তু দেব-দেবীর বাহন বলে কিছু হয় না। বাহন বলতে আমরা বুঝি যে বহন করে। কিন্তু দেব-দেবীরা এমনিতেই প্রত্যেকে সুপার পাওয়ারের শক্তি সম্পন্ন, কোথাও যেতে হলে তাদেরকে কারো বা কোনো কিছুর উপর ভরসা করতে হয় না। দেব-দেবীর বাহন বলা মানেই সেই দেব-দেবীর ক্ষমতাকে ছোটো করা। দেব-দেবীর বাহন তত্ত্বকে স্বীকার করলেই এই প্রশ্ন উঠবে যে, যে দেব-দেবী নিজেই কোথাও যেতে পারে না, সেই দেব-দেবীর আর কী ক্ষমতা আছে, আর তাদেরকে পূজা করেই বা কী লাভ ? তাই দেব-দেবীদের বাহন বলে কিছু নেই; তাহলে দেব-দেবীর বাহন বলতে আমরা এতদিন যা জেনে এসেছি এবং দেব-দেবীদের সাথে আর অন্য যা কিছু থাকে সেগুলো আসলে কিসের জন্য থাকে আর এগুলো থাকার কারণই বা কী ?
মূর্তি পূজা এক ধরণের প্রতীকী পূজা এবং প্রকৃত সত্য হচ্ছে, কোনো মূর্তিরই ক্ষমতা নেই আপনাকে কিছু দেওয়ার; কিন্তু প্রতিটি মূর্তির সাথে যে বিষয়গুলো জড়িত থাকে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশেষ কিছু তথ্য বা শিক্ষা, আপনি যদি সেই বিষয়গুলোর প্রকৃত ব্যাখ্যা জানেন বা জানতে পারেন, তাহলেই কেবল সফল বা সার্থক হতে পারে আপনার পূজা এবং তা থেকে আপনি কিছু না কিছু ফল লাভ করতে পারেন।
রাজহাসেঁর মধ্যে এমন ক্ষমতা আছে যে, এক পাত্রে থাকা জল মিশ্রিত দুধের থেকে সে শুধুমাত্র দুধ শুষে নিতে পারে।সরস্বতী যেহেতু শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট পূজা, সেই প্রেক্ষাপটে এটা বলা যেতে পারে যে, রাজহাসেঁর এই তথ্য শিক্ষার্থীদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, সমাজে ভালো মন্দ সব কিছুই থাকবে, তার মধ্যে থেকে তোমাদেরকে শুধু ভালোটুকু শুষে নিতে হবে। অধিকাংশ হিন্দু ছেলে-মেয়েরা যে মেধাবী এবং চরিত্রবান বা চরিত্রবতী, সরস্বতী পূজা এবং তার রাজহাঁসজনিত এই শিক্ষাই তার কারণ।
সরস্বতীর হাতে থাকে বীণা; এর কারণ হচ্ছে-হিন্দু ধর্ম হলো নাচ, গান সমৃদ্ধ শিল্পকলার ধর্ম; যা সামাজিক বাস্তবতাকে সম্পূর্ণভাবে সাপোর্ট করে। কারণ, প্রত্যেক ছেলে মেয়েই কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহন করে; সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে কেউ তার সেই প্রতিভাকে বিকাশ করতে পারে, কেউ পারে না, সেটা অন্য ব্যাপার; কিন্তু প্রকৃতির ধর্ম হিসেবে হিন্দু ধর্ম এই সামাজিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে, এই কারণেই দেবী সরস্বতীর হাতের বীণা হচ্ছে সেই শিল্পকলার প্রতীক। আর এটা সুধীজন স্বীকৃত যে, যারা- নাচ, গান, কবিতা লেখা বা নাট্যচর্চার মতো শিল্পকলার সাথে জড়িত, তারা সাধারণত কখনো মিথ্যাও বলে না; চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ তো দূরের ব্যাপার। সাধারণভাবে সকল হিন্দুই যে সৎ প্রকৃতির এবং প্রত্যেক হিন্দু ছেলে মেয়েই যে শিল্পকলার কিছু না কিছু না জানে, এটাই তার অন্যতম কারণ ।
সরসস্বতীর হাতে থাকে পুস্তক এবং সরস্বতী পূজাতেও বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক দিতে হয়। পুস্তক যে জ্ঞানের আশ্রয়, এটা তো আর নতুন কোনো কথা নয়; একারণেই হিন্দুরা একটি জ্ঞান পিপাসু এবং জ্ঞান সমৃদ্ধ জাতি। এখনও যেকোনো স্কুলে যে কয়জন হিন্দু ছাত্র ছাত্রী পাবেন, দেখবেন তাদের মধ্যে ৯০% ই জিনিয়াস।
বর্তমানে দেবী সরস্বতীকে দুই হাত বিশিষ্ট দেখা গেলেও দেবী সরস্বতীর মূল মূর্তি আসলে চার হাত বিশিষ্ট, এরকম ছবি আপনারা অনেকে জায়গায় দেখতে পেতে পারেন, সরস্বতীর মূল থিমের সাথে এই চার হাত ই মানানসই; কারণ হলো- পড়াশুনার পাশাপাশি কেউ যদি নাচ গান বা অন্য যে কোনো শিল্পকলায় এক্সপার্ট হতে চায়, তাকে দুই হাতের শক্তি ও ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করলে চলবে না, তাকে চার হাতের শক্তি ও ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করত হবে; বাস্তবে পড়াশুনার পাশাপাশি যারা বিভিন্ন শিল্পকলায় দক্ষ হয়ে ওঠে, তাদের জীবন এইরকম ব্যস্ততাতেই ভরা; একটু খোঁজ নিলেই আমার এই কথার সত্যতা বুঝতে পারবেন।
অনেক কাঠামোতে দেখা যায়, সরস্বতী দেবী হাঁসের উপর বসে আছে আবার কোনো কাঠামোয় দেখা যায় পদ্মফুলের উপর; পদ্মফুলের উপ সরস্বতীর আসন ই সঠিক আসন। এর কারণ- পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মফুল হলো সফল ও সমৃদ্ধ জীবনের প্রতীক; এই কারণেই লেখা হয়েছে- “ফুলের মতো গড়বো মোরা মোদের এই জীবন” এই ধরণের কবিতা। এককথায় ফুলের বিকাশের সাথে মানুষের জীবনের বিকাশকে তুলনা করা হয়েছে। পূর্ণ বিকশিত একটি পদ্মফুলের উপর সরস্বতীর বসে থাকার মানে হলো- সরস্বতীর আদর্শকে লালন করে নিজের জীবনকে বিকশিত করতে পারলে সেই জীবনও ফুলের মতোই পবিত্র, সুন্দর, বিকশিত ও সমৃদ্ধ হবে।
স্বয়ং ঈশ্বর হলেও সরস্বতী নারী মূর্তি অর্থাৎ মাতৃমূর্তি, এর কারণ হলো- পিতার চেয়ে মায়ের কাছে কোনো কথা বলা সহজ বা কোনো কিচু চাওয়া সহজ। সরস্বতীর পূজারীরা যেহেতু সাধারণভাবে শিশু বা বালক-বালিকা অর্থাৎ শিক্ষার্থী, তাই তারা যাতে সহজে নিজের মনের কথা নিজের মনের আকুতি, দেবী মায়ের কাছে জানাতে পারে, এজন্যই সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে মাতৃরূপে।
এখানে একটি ছোট্ট তথ্য দিয়ে রাখি, বৌদ্ধরাও সরস্বতী পূজা করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেবী সরস্বতীই যদি একমাত্র জ্ঞানদাত্রী হয়, তাহলে যারা সরস্বতীর পূজা করে না, যেমন- মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা; তারা কি জ্ঞান অর্জন করে না ?
বাংলাদেশে, প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়, ১৬ ডিসেম্বর এবং ২৬ মার্চেও জাতীয় স্মৃতিসৌধেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়, ভারতসহ অনেক দেশেই এমনটা করা হয়, এটা আসলে একপ্রকার পূজা। কিন্তু এই ফুল পেয়ে, যারা মরে গেছে, তাদের কি কোনো উপকার হয় ? এক কথায়, না। তারপরেও কেনো আমরা প্রতিবছর ঐসব অনুষ্ঠানের আয়োজন কেনো করি ?
আসলে এই সব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু তথ্য নতুন প্রজন্মের স্মৃতিতে ট্রান্সফার করা হয়, আর তাদের মধ্যে সেই সকল ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা হয়, যারা দেশ ও জাতির জন্য কিছু না কিছু করেছে ? এই একদিনের শ্রদ্ধাবোধ একটি পরম্পরা তৈরি করে, যা বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। কারণ, এই একদিনের শ্রদ্ধাবোধ মানুষের মস্তিষ্ক্যে এমন একটি প্রভাব ফেলে যা তাকে ঐ পরম্পরাটি বয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
আমরা শ্রদ্ধাভরে যখন কোনো দেব-দেবীর পূজা করি, তখন আমাদের ব্রেইন এর মধ্যে ঠিক এমনই একটি প্রভাব কাজ করে, যে প্রভাবটি ঐ পূজা ব্যতীত কিছুতেই সৃষ্টি হতো না। ব্রেইন এর মধ্যে এই যে প্রভাব, সেটি আসলে কিভাবে আমাদেরকে সাহা্য্য করে ?
কোয়ান্টাম মেথডের সূত্রানূসারে যখন আমরা কোনো কিছু মনে প্রাণে চাই এবং বার বার চাই, তখন ব্রেইন সেটা আমাদেরকে পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমাদেরকে সেভাবে পরিচালিত করা শুরু করে এবং আমাদের চারপাশে সেইরকম পরিবেশ তৈরি করে। এভাবে ব্রেইন অবচেতনভাবে কাজ করেই আমাদেরকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুর কাছে পৌঁছে দেয়। এজন্যই আমরা যেটা বার বার ভাবি বা করতে চাই, খুব অসম্ভব কিছু না হলে সেটা আমরা পেয়েই যাই । আমাদের সকল পূজা প্রতীকী হলেও, পূজার মাধ্যমে আমাদের ঐকান্তিক চাওয়া, আমাদের ব্রেইন আসলে সেভাবেই পূরণ করে দেয়। কারণ, দেব-দেবীর কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা মূলত আমাদের মস্তিষ্ক্যে সেই বিষয়টি লোড করে দিই বা মস্তিষ্ক্যকে সেই নির্দেশনা দিই, আর আমাদের মস্তিষ্ক্য আমাদেরকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করতে থাকে এবং এভাবেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাই।
এটা শুধু হিন্দুদের পূজা প্রার্থনার ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো ধর্মের লোক তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী প্রার্থনা করলেও তার ব্রেইন এর মাধ্যমে সে একই ফল পায় বা পাবে। তো যে ছেলে বা মেয়েটা সরস্বতীর কাছে সরল বিশ্বাসে এই প্রার্থনা করছে যে- মা, আমাকে জ্ঞান দাও, বুদ্ধি দাও; এই চাওয়ার ফলে সরস্বতীর উছিলায় তার ব্রেইন তাকে এমনভাবে পরিচালিত করে, যার ফলে তার বাড়তি কিছু জ্ঞান-বুদ্ধি লাভ হবেই। কারণ, যে বিদ্যালাভের জন্য প্রার্থনা করবে, সে বই নিয়ে দু চারদিন বেশি বা দুই চার ঘন্টা বেশি পড়বেই, সরস্বতীর উছিলায় কাজ হয় বা হবে এভাবেই; একইভাবে যে লোক, ধনের জন্য লক্ষ্মীর কাছে প্রার্থনা করছে, লক্ষ্মীর উছিলায় তার ব্রেইনও সেই লোককে এমন সব পদক্ষেপ নেওয়াচ্ছে যাতে তার ভালো রোজগার হতে বাধ্য। কোনো অলৌকিক দেব-দেবী বা কোনো অলৌকিক সৃষ্টিকর্তা আসলে কারো জন্য কিছু করতে পারে না বা কাউকে কিছু দিতে পারে না। মানুষ তাদের বিশ্বাসের দেব-দেবী বা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে মূলত তাদের নিজেদের ব্রেইনকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয় বা তাদের চিন্তার ফলই তাদেরকে ফল দেয়।
পৃথিবীর সব ছাত্রই চায় ভালো রেজাল্ট করতে, এর জন্য তারা পড়াশুনার পাশাপাশি নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী কামনা করে যেন তার পড়াশুনা ভালো হয় এবং পরীক্ষার ভালো করতে পারে; কোনো অলৌকিক সত্ত্বার কাছে কোনো প্রার্থনা করলে বা না করলেও তাদের মনের এই কামনাই তাদেরকে পৌঁছে দেয় তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে, আর এভাবেই সরস্বতী পূজা না করেও যে যার মতো অর্জন করতে পারে জ্ঞান।
এখন বিজ্ঞানের এইসব নিগূঢ় তথ্য সবার পক্ষে জানা সম্ভব হয় না আর সাধারণ সব লোকের পক্ষে এটা বোঝাও সম্ভব নয়। যারা এই বিজ্ঞান জানে বা বোঝে, তারা লক্ষ্মী সরস্বতীর পূজা না করেও নিজেদের ব্রেইনকে কমান্ড করে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারে। কিন্তু যাদের কাছে বিজ্ঞানের এই জ্ঞান পৌঁছে নি বা যাদের পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব নয়, তারা সরল বিশ্বাসে জ্ঞান বুদ্ধির জন্য যদি সরস্বতীর কাছে এবং ধনের জন্য লক্ষ্মীর কাছে প্রার্থনা করে, একই ফল লাভ করবে। তবে এখানে একটা বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে, যে কোনো দেব-দেবীর কাছে পূজার নামে প্রার্থনা করতে হবে আপনার নিজেকে এবং এ্ই প্রার্থনা করতে হবে অবশ্যই মাতৃভাষায়। পুরোহিতকে দিয়ে যদি বাড়িতে পূজা করিয়ে নেন, আর আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ যদি সেই দেব-দেবীর কাছে কোনো প্রার্থনা না করেন, তাহলে সেই পূজা পুরোটাই বেকার, শুধুই অর্থ খরচ। এখানে আর একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, যেকোনো পূজার জন্য আমরা যতসব আয়োজন করি, সেটা ঐ পূজাটাকে একটা অনুষ্ঠানে রূপ দিতে সাহা্য্য করে মাত্র; ফুল-জল-বেলপাতা ঐ দেব-দেবীর প্রতি আত্মসমর্পনের একটা প্রসেস মাত্র; কারণ, একমাত্র আত্মসমর্পণকারী ব্যক্তিই পারে অহংকারমুক্ত হয়ে প্রকৃত অর্থে প্রার্থনা বা কামনা জানাতে। এ কারণে আমরা যদি কোনো পূজার আয়োজন না করেও শুধু দেব-দেবীর মূর্তি বা তাদের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বা বসে প্রতিদিন প্রার্থনা করি, পূজার মতো একই ফল লাভ হবে, যে পদ্ধতিতে প্রার্থনা করে- ইসলাম, খ্রিষ্ট এবং ইহুদি মতাবলম্বীরা।
সুতরাং এই আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, হিন্দুধর্ম ও কালচারের কোনো কিছুই অযথা বা নিরর্থক নয়, সব কিছুরই সুষ্পষ্ট কারণ এবং তার কার্যকারিতা অর্থাৎ উপকারিতা রয়েছে; এই সব তথ্য যারা জানে না, সেটা তাদের দুর্বলতা, কিন্তু সনাতন তথা হিন্দু ধর্মের কোথাও কোনো দুর্বলতা নেই।

কোন মন্তব্য নেই

thanks. please visit again

Blogger দ্বারা পরিচালিত.