শিব কে? Who is god Shiv?
শিব কে ? ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সবচেয়ে বিশিষ্ট এই চরিত্রটিকে ঘিরে অনেক কাহিনী এবং কিংবদন্তী রয়েছে । তিনি কি একজন দেবতা ? নাকি হিন্দু সংস্কৃতির সমবেত কল্পনা থেকে তৈরি এক পৌরাণিক কাহিনী? নাকি শিবের কোনো গভীর অর্থ আছে, যা প্রকাশ পায় কেবল তাদের কাছে যারা সন্ধান করে ?
যখন আমরা শিব বলি, আমরা দুটি মৌলিক দিককে উল্লেখ করছি। শিব শব্দটির মানে আক্ষরিক অর্থে হলো যা নয় সেটা। আজ, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের কাছে প্রমাণ করছে যে সবকিছু শূন্য থেকে আসে এবং শূন্যে ফিরে যায়। অস্তিত্বের ভিত্তি এবং মহাজগতের মৌলিক গুণ হলো বিশাল শূন্যতা। ছায়াপথগুলো হলো একটা ছোট ঘটনা - ছিটেমাত্র । বাকি সমস্তটাই বিশাল শূন্যস্থান, যা শিব বলে উল্লেখ করা হয় | এই সেই গর্ভ যার থেকে সবকিছুর জন্ম হয়, এবং এই সেই বিস্মৃতি যার মধ্যে সবকিছু ফিরে যায়। সবকিছু শিব থেকে আসে এবং শিব-এ ফিরে যায়। শিব শব্দের উৎপত্তি শী-ধাতু(শয়ন)থেকে। তার মানে, সবাই এবং সব কিছু যার মধ্যে শায়িত বা অধিষ্ঠিত, যিনি সবারই আশ্রয়। আর বিশ্বব্রহ্মান্ড সমস্থ কিছুর আশ্রয় অর্থ্যাৎ পরমব্রহ্ম স্বরূপ অর্থ্যাৎ নিরাকার ঈশ্বর।যিনি সমস্থ গুনের (ব্যাক্তিত্বের)আধার। এই দর্শন কে ভালো ভাবে বোঝার জন্য শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদের মূল ভাবার্থ বুঝতে হবে।
(শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদ)
শঙ্করাচার্য্য বিশ্বসত্তাকে অবিভাজ্য এবং এক কল্পনা করেছেন বলেই তাঁর মতবাদকে অদ্বৈতবাদ বলা হয়| তিনি শিক্ষা দিলেন – ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ – অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য, এই বিশ্ব মিথ্যা এবং জীবাত্মা ও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন| এই যে জগৎ প্রত্যক্ষ হচ্ছে যা পরিবর্তনশীল এবং যা নাম ও রূপ এই দুয়ের সমন্বয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা ভ্রম মাত্র যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম| এই ভ্রম ব্রহ্মের মায়াশক্তির প্রভাব। একই কথা উল্লেখ আছে।
শিব শব্দের অর্থ মঙ্গল। তাই প্রতিটি মঙ্গলময় জিনিস বা ব্যাক্তিত্ব হল শিবস্বরূপ। আর মঙ্গলকে আশ্রয় না করে কইজন বাঁচতে পারে? তাই শিব সবারই আশ্রয়স্থল। তেমনি শিব ব্যাক্তিত্বের ব্যাক্তি মঙ্গলময় ও আশ্রয়দাতার প্রতিক। তাহার নাম ভূতেশ, ভূতভাবন।এখানে ভূত মানে কাল অর্থ্যাৎ যিনি বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎতেও থাকবেন। তাইতো তিনি ভূতনাথ অর্থ্যাৎ জীব আত্মা যা চিরন্তন সত্য ও শাশ্বত তার প্রভু।
অর্থাৎ , এক অর্থে ব্রহ্মেরই আরেক গুনবাচক নাম হলো শিব। শাস্ত্র মতে, সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হলো পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ব্রহ্মও বলা হয়। পরমাত্মারূপে এই ব্রহ্ম সবকিছুর মধ্যে বিরাজিত, এই জন্যই হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম
এর অর্থ হলো- সকলের মধ্যে ব্রহ্ম বিদ্যমান। - (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১, বেদান্ত দর্শন)
পরমব্রহ্ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তার নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তার নাম বিষ্ণু; যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তার নাম শিব বা মহেশ্বর। কিন্তু আমরা স্থূল দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে বিভক্ত করে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরে এই তিনভাগে বিভক্ত করেছি এবং এই তিনটি সত্ত্বাকে আলাদা আলাদা তিনটি রূপ দান করেছি। প্রকৃতপক্ষে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, এগুলো জাস্ট তিনটি নাম এবং এই তিনটি নাম পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের তিনটি কার্যকরী রূপের নাম মাত্র।
জড় জগতের তিনটি অবস্থা সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়। ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু হলেন পালনকর্তা, আর শম্ভু বা দেবাদিদেব মহাদেব হলেন সংহার কর্তা। সমগ্র জড় জগৎ জড় প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সত্ত্ব গুণের অধীশ্বর হলেন বিষ্ণু। রজ গুণের অধীশ্বর হলেন ব্রহ্মা এবং তম গুণের অধীশ্বর হলেন শিব বা শম্ভু।
‘শিব’ শব্দটির অর্থ হলো ‘মঙ্গলময়’। তা সত্ত্বেও শ্রীমদ্ভাগবতের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি ভগবান শিবের নির্মল স্বর্ণাভ দেহ ভষ্মের দ্বারা আচ্ছাদিত। তার জটাজুট শ্মশানের ধূলির প্রভাবে ধূম্র বর্ণ। তিনি সন্ধ্যাকালে ভূতগণ পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁর তার বাহন বৃষভের পিঠে চড়ে ভ্রমণ করেন। অথচ ব্রহ্মার মতো মহাপুরুষেরা তাঁর শ্রীপাদপদ্মে নিবেদিত পুষ্প মস্তকে ধারণ করেন।
শিব জীবতত্ত্ব নন। শিব বিষ্ণুতত্ত্বও নন। শিব হচ্ছেন বিষ্ণুতত্ত্ব ও জীবতত্ত্বের মধ্যবর্তী শিবতত্ত্ব বা শম্ভুতত্ত্ব। বিষ্ণু তত্ত্বের মধ্যে ৬০টি দিব্যগুণ প্রকাশিত হয়। শুদ্ধ জীবাত্মার মধ্যে সর্বাধিক ৫০টি দিব্যগুণ প্রকাশিত হয় আর শিবতত্ত্ব বা শম্ভুতত্ত্বের মধ্যে ৫৫টি দিব্যগুণ প্রকাশিত হয়।
শিবের অপর নাম নীলকন্ঠ। সমুদ্র মন্থনে উত্থিত হলাহলের প্রভাব যখন সমগ্র সৃষ্টিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন দেবতাগণ শিবের শরণ গ্রহণ করেছিলেন। দেবতাদের বিনীত প্রার্থনায় খুশি হয়ে করুণাবশতঃ শিব দেবতাদের সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর নিত্যশক্তি ভবানীর প্রতি আলোচনার সুরে বলেছিলেন, হে সাধ্বী ভবানী, কেউ যখন পরোপকার করে, তখন ভগবান শ্রীহরি অত্যন্ত প্রসন্ন হন, তখন আমিও অন্যান্য প্রণীসহ প্রসন্ন হই। তাই আমি এই বিষ পান করব। আমার দ্বারা সকলের মঙ্গল সাধন হোক।
কোন মন্তব্য নেই
thanks. please visit again